গতকাল ৬ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার বেলা এগারোটা থেকে ক্যাম্প শুরু করার কথা থাকলেও নির্ধারিত স্থানে আমাদের টিমের পৌঁছতে পৌঁছতে বেজে গেলো প্রায় সাড়ে বারোটা। ফেনীর ফুলগাজী থানার মান্দারপুর এলাকাটি বেশ প্রত্যন্ত একটি এলাকা শুনে আসলেও এটা যে আসলে কতটা ভেতরে সেটা আমরা বুঝতে পারলাম ওখানে পৌঁছানোর পর। ফকিরেরখীল মান্দারপুর আবুল খায়ের মজুঃ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা যখন ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাজাচ্ছি ক্যাম্পের জন্য, দেখতে পেলাম কিছু দূরেই দেখা যাচ্ছে ভারত সীমান্ত। জানতে পারলাম, সাম্প্রতিক বন্যায় যেসব এলাকা প্রাথমিকভাবে এবং সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বলছিলাম বন্যার্তদের চিকিৎসা সাহায্যে ফার্মেসী অ্যাল্যামনাই অ্যাসোসিয়েশন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (PAAKU) কর্তৃক আয়োজিত বন্যা পরবর্তী দুরবস্থা মোকাবেলায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনার দিনের কথা। গত ২১ আগস্ট ভারী বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ফেনী, নোয়াখালী সহ ১১ জেলার ৭৩ টি উপজেলা প্লাবিত হয়। পুরো দেশবাসীর মত 'পাকু'ও এগিয়ে আসে এই ভয়ানক পরিস্থিতি মোকাবেলায়। প্রাথমিকভাবে আমাদের সাহায্য পরিকল্পনাকে যে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয় (জরুরী ত্রাণ সরবরাহ, বন্যা পরবর্তী রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এবং পুনর্বাসন) তার মধ্যে গতকাল ৬ সেপ্টেম্বর ফেনীর ফুলগাজীতে মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনাটি ছিল দ্বিতীয় ধাপ। প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করে নির্ধারণ করা হয় কোন এলাকাটিতে সবথেকে বেশি প্রয়োজন চিকিৎসা সেবা। ডাক্তার যারা অংশগ্রহণ করেন আমাদের সাথে তাদের মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধের একটি তালিকা করা হয় এবং সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছিল জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি, অ্যালার্জি ও অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক ও অইন্টমেন্ট। ছিল ব্যথানাশক, কৃমিনাশক, মাল্টিভিটামিনস ও মিনারেলস, সাথে সাথে পেটের পিড়া, গ্যাস্ট্রাইটিসের ওষুধ। এছাড়া খাবার স্যালাইন, প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ। ওষুধ সামগ্রীর তালিকা করার সময় প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের কথা বিশেষভাবে মাথায় রাখা হয়।
৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২ টায় নির্ধারিত স্থানে পৌঁছায় পাকুর দশ জনের একটি মেডিকেল টিম এবং আন্দাজ বেলা ১ টা থেকে শুরু হয় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এবং চিকিৎসা প্রদান। স্কুলের তিনটি কক্ষের একটিতে পুরুষ, আরেকটিতে নারী ও শিশুদের সেবার ব্যবস্থা করা হয়, এবং তৃতীয় কক্ষটিতে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ বিতরণ করা হয়। বন্যা পরবর্তী সময়ে যেসব রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় সেসব সহ সকল প্রকার সাধারণ রোগ সনাক্ত করেন ডাক্তাররা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ ও নির্দেশনা সরবরাহ করেন। ডাক্তারগণ এবং পাকুর স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রায় ছয় ঘণ্টার অনবরত সেবা দেয় আগত প্রায় তিনশতাধিক রোগী ও সেবাপ্রার্থীদের। সন্ধ্যা সাতটায় শেষ হয় এ কার্যক্রম।
ডাক্তার হিসেবে আমাদের সাথে ছিলেন ডা. সিয়াম সিদ্দিকী ফাহিম, ডা. গাজী সাজ্জাদ হোসেন, ডা. মোঃ হেদায়েতুল কবির এবং ডা. নুজহাত জামান সেমন্তী। মেডিকেল ক্যাম্পের পুরোটা সময় তাদের নিরলস সেবা এই সফল ক্যাম্পটি সম্পন্ন করতে বিরাট অবদান রেখেছে। সাথে সাথে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন যাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জনাব সাইদুর রহমান। তিনি এই দুর্যোগের শুরু থেকে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কাজ করছেন এবং এই মেডিকেল ক্যাম্পের শুরু থেকে পুরোটা সময় পাকু মেডিকেল টিমকে তাদের কাজে সহায়তা করে গেছেন। স্থানীয় সকলের আন্তরিকতা ও অভ্যর্থনা আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সাবলীলভাবে এবং পরিকল্পনানুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে আমাদের পুরো প্রচেষ্টাটি।
মেডিকেল টিমে দশ জন গেলেও এর পিছনে কাজ করেছে অ্যাসোসিয়েশনের একটি বিরাট টিম। তাদের পরামর্শ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা অপরিহার্য ছিল পুরোটা সময়ে। তবুও, আমাদের কাজ এখানেই শেষ নয়। পাকু চায় বন্যা কবলিতদের সাহায্যে পরিকল্পিত তিনটি ধাপের প্রথম দুটি যেভাবে সফলভাবে শেষ করেছে তারা, শেষ ধাপটিতেও এর ধারাবাহিকতা রাখতে। বন্যায় আক্রান্ত কয়েকটি পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করবে পাকু। সাথে সাথে আগামীর যে কোনো জাতীয় সমস্যা বা প্রয়োজনীয়তাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ অবদান রেখে যেতে চায় ফার্মেসী অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (PAAKU)।
এমন হাজার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং দেশের শত শত ছোটো থেকে বড় সংঘ ও সংগঠনের এভাবে এগিয়ে আসাটাই পারে এমন দুর্যোগ দ্রুত মোকাবেলা করতে। সবাই এগিয়ে আসুক, আমরা এগোলেই এগোবে দেশ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন